অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, নারী-পুরুষসহ সবার প্রতি সালাম জানিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন,
“শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, নারী-পুরুষ, নবীন-প্রবীণ সবাইকে আমার সালাম জানাচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম।”
তিনি স্মরণ করেন যে গত বছর আগস্টে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিবলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল এবং এখন সরকার তাদের মেয়াদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে।
ড. ইউনূস বলেন, সরকারের উপর তিনটি প্রধান দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল—
১) হত্যাকাণ্ডের বিচার, ২) গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সংস্কার, এবং ৩) সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় প্রথম রায় শিগগিরই দিতে যাচ্ছে এবং আরও কয়েকটি মামলা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সাধারণ আদালতেও বিচার কাজ শুরু হয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গুমের বিচারও শুরু হয়েছে।
সংস্কারের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি জানান—অন্তর্বর্তী সরকার নিজের উদ্যোগে বা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচার ব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ডিজিটালাইজেশন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে নির্বাচিত সরকার সংসদে আলোচনার মাধ্যমে এসব সংস্কার গ্রহণ করবে।
তিনি ঘোষণা করেন,
“আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম অর্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।”
সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনে সব প্রস্তুতি চলছে।
ড. ইউনূস জানান, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রায় ৯ মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি টিভিতে সম্প্রচারিত আলোচনায় কাজ করেছে এবং সংবিধান বিষয়ক ৩০টি সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, বাহ্যিকভাবে মতপার্থক্য দেখা গেলেও গভীরে তা খুব সামান্য—সংস্কারের মূল লক্ষ্য ও নীতিতে কেউই ভিন্নমত নয়। এটি দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন।
আজকের উপদেষ্টা সভায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন হয়েছে, যা এখন গেজেট প্রকাশের পর্যায়ে। এই আদেশে রয়েছে—
- সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গণভোট আয়োজন,
- নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন,
- সংবিধানে জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া।
ড. ইউনূস ঘোষণা করেন—
“জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।”
অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথম অর্ধে একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হবে।
তিনি গণভোটে উপস্থাপিত প্রশ্নও হুবহু পড়ে শোনান। এতে চারটি বিষয়ের প্রতি ভোটারদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ মত দিতে হবে—
ক. নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদের প্রক্রিয়ায় গঠন
খ. আগামী সংসদ দুই কক্ষবিশিষ্ট হবে এবং ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যের উচ্চ কক্ষ গঠিত হবে
গ. ৩০টি সংস্কার বাস্তবায়নে বিজয়ী দল বাধ্য থাকবে
ঘ. অন্যান্য সংস্কারও জুলাই সনদ অনুযায়ী বাস্তবায়িত হবে
গণভোটে ‘হ্যাঁ’ হলে—
- নির্বাচিত এমপিদের নিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করা হবে,
- পরিষদ প্রথম অধিবেশন থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে,
- এরপর ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে উচ্চকক্ষ গঠন হবে,
- এবং সংবিধানে জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্ত হবে।
অর্থনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
“রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রিজার্ভসহ অর্থনীতির সবগুলো সূচকে দেশ ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।”
ব্যাংকিং খাত লুটপাট থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং FDI অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম বছরে ১৯.১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আগামী সপ্তাহে ডেনমার্কভিত্তিক Maersk গ্রুপের মালিকানাধীন APM Terminals B.V.-এর সঙ্গে লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্পে ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষর হবে, যার বিনিয়োগ ৫৫০ মিলিয়ন ডলার—এটি বাংলাদেশে ইউরোপের সর্বোচ্চ একক বিনিয়োগ এবং দেশের প্রথম বিশ্বমানের গ্রীন পোর্ট হবে।
ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করে বলেন—
“দলগুলো ঐক্যবদ্ধ না থাকলে জাতি এক মহাবিপদের সম্মুখীন হবে।”
তিনি ১৩৩ শিশু ও শত শত তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতার আহ্বান জানান।
ভাষণের শেষভাগে তিনি বলেন—
“আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছলাম। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন… আল্লাহ হাফেজ।”



