দেশের ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে এক হাজারের বেশি ঋণগ্রহীতা আদালতে রিট করেছেন। এসব ঋণগ্রহীতা প্রকৃতপক্ষে খেলাপিযোগ্য হলেও আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে তা নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ যথাসময়ে ঋণের কিস্তি ফেরত না দেওয়ার দায়ে এসব ঋণগ্রহীতা বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তালিকায় ওঠার কথা থাকলেও আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে সেটি হয়নি। বরং রিটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তারা ঠিকই খেলাপির তকমা থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে এক হাজার ৮৬ জন ঋণগ্রহীতা ২৭ হাজার ৩০২টি ঋণের বিপরীতে আদালতে রিট পিটিশন করেছেন। রিট পিটিশনের কারণে ব্যাংকগুলোর এক লাখ ৬৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আটকে আছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব খেলাপি ঋণ মামলায় ঝুলছে।
জানা যায়, সিআইবিতে যাতে নাম না ওঠে, সে জন্য আগে হাইকোর্টে রিট করতেন ঋণখেলাপিরা। ২০১৮ সালের শেষ দিকে আপিল বিভাগের আদেশে উচ্চ আদালতে এ ধরনের রিটের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ঋণখেলাপিরা থেমে নেই, তারা নতুন কৌশল হিসেবে নাম তালিকাভুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে প্রথমে নিম্ন আদালতে একটি ঘোষণামূলক মামলা করেন। সেই মামলা খারিজ হয়ে গেলে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ নিম্ন আদালতে আদেশ সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেন। পরে স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়তে থাকে। অর্থাৎ সিআইবিতে নাম অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে ঋণখেলাপিরা এ কৌশল প্রয়োগ করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইচ্ছা করে ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণে কোনো আইন বা নীতিমালা বাংলাদেশে নেই। এ সুযোগে অনেকেই ঋণের টাকা যথাসময়ে ফেরত দেন না। উল্টো খেলাপির তকমা থেকে রেহাই পেতে কিংবা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে বছরের পর বছর নিয়মিত থাকেন। আবার খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ঋণ মঞ্জুরির ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ প্রজেক্ট প্রোফাইল, গ্রাহকের ইকুইটি না থাকা, বন্ধকি সম্পত্তির মালিকানা সঠিক না হওয়া, প্রয়োজনের চেয়ে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম হওয়া ও বিচারকের অভাব এবং আইনি মতামতের জন্য ব্যাংকের আইনজীবীকে পর্যাপ্ত সময় ও সহায়ক জামানতের পর্যাপ্ত দলিলাদি সরবরাহ করতে না পারায় অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতেও দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আমার দেশকে বলেন, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে ব্যাংকগুলোর অনেক টাকা আটকে আছে। এভাবে স্থগিতাদেশ দেওয়া আর্থিক খাতের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়, যা খুবই ক্ষতিকর। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে ঢালাওভাবে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয় না। আর্থিক খাতকে সচল রাখতে হলে বিচার বিভাগকেও তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
তিনি আরো বলেন, একটা আধুনিক অর্থনীতির বিচার বিভাগও আধুনিক হওয়া প্রয়োজন। বিচার বিভাগের সংস্কারের প্রয়োজন আছে, যেটা তাদেরই করতে হবে। দেশের লাখ লাখ মামলা ঝুলে আছে, এতেই প্রমাণ করে আমাদের কোর্ট সিস্টেম ত্রুটিপূর্ণ। গত বছর মামলায় আটকে থাকা অর্থ আদায়ে ব্যাংকের আইন বিভাগকে শক্তিশালী করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অর্থঋণ আদালতে মামলাধীন। অনেক খেলাপি ঋণের বিপরীতে ঋণগ্রহীতা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বা আপিল বিভাগে রিট পিটিশন করেছেন। যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ব্যাংকের লিগ্যাল টিমকে আরো শক্তিশালী করা হলে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে।
এ জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে একজন চিফ লিগ্যাল অফিসার পদায়ন করতে হবে। তিনি মামলাধীন ঋণগুলোর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় নীতি, কৌশল ও পদ্ধতি প্রণয়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। চিফ লিগ্যাল অফিসারকে অবশ্যই কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএলবি) ডিগ্রিধারী হতে হবে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল টিমে ন্যূনতম পাঁচ বছর কাজের অভিজ্ঞতা এবং সংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, অর্থঋণ আদালত, হাইকোর্ট বিভাগ, আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এবং এর বিপরীতে অনাদায়ী অর্থের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে লিগ্যাল টিমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ জনবল নিতে হবে। লিগ্যাল টিমের জনবলের ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ কর্মকর্তার আইন বিষয়ে ডিগ্রি এবং ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি হয়েছে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৭ শতাংশ। এর বাইরে মামলা আটকে আছে এক লাখ ৬৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণের সঙ্গে মামলা আটকে থাকা ঋণ আমলে নিলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ছয় লাখ ৯৩ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা।