আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দীর্ঘ দমন-পীড়নের পর নির্বাচনী মাঠে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পাওয়ায় দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে কর্মীরা পর্যন্ত এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। জুলাই বিপ্লবের পর রাজনৈতিক পরিবেশ পরিবর্তিত হওয়ায় এবং দলীয় কার্যক্রম পরিচালনায় আর আগের মতো বাধার মুখে না পড়ায় তারা মনে করছে, এ নির্বাচন দাঁড়িপাল্লার জন্য একটি ঐতিহাসিক টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করতে পারে। দলটি বিশ্বাস করছে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশ বজায় থাকলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা নীরব সমর্থন ভোটবাক্সে অভাবনীয় চিত্র তৈরি করবে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং বিভাগীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারাদেশে প্রার্থীরা যে গণসংযোগ পরিচালনা করছেন, সেখানে দলীয় সমর্থকদের পাশাপাশি হাজারো সাধারণ মানুষও প্রতিদিন কাছে টানছেন। প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার প্রতি মানুষের হতাশা, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সুশাসনের প্রত্যাশা—এসব মিলে জামায়াতের প্রতি নতুন করে আগ্রহ জন্মেছে বলে দাবি করছেন নেতারা। বিশেষ করে নারী ভোটার, কম আয়ের শ্রমজীবী মানুষ এবং তরুণ প্রজন্ম এবার আগের তুলনায় দাঁড়িপাল্লার দিকে বেশি ঝুঁকছেন বলে মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণে জানা গেছে।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত টানা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জামায়াত ছিল সর্বাধিক চাপে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর একটি। দলের শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের বহু নেতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে বিচার, কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও নিপীড়নের অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি দলীয় সভা-সমাবেশে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা, অফিস বন্ধ করে দেওয়া, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়মিত বাধা—সব মিলিয়ে প্রায় দেড় দশক জামায়াতের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের স্থবিরতা নেমে আসে। সরকার পতনের আগে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, যা তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বই সংকটের মুখে ঠেলে দেয়।
জুলাই বিপ্লবের পর রাজনৈতিক পরিবেশ বদলে যাওয়ায় দলটির সংগঠন আবারো মাঠে কর্মসূচি গ্রহণে কার্যত বাধামুক্ত হয়েছে। ফলে শুধু পুরানো কাঠামো পুনর্গঠনই নয়, নতুন নেতৃত্বও যোগ হয়েছে। ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রটি দীর্ঘদিন পর পূর্ণমাত্রায় উন্মুক্ত হওয়ায় নেতৃত্ব মনে করছে যে, এই নির্বাচন জামায়াতের জন্য শুধু রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন নয়, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বর্ণাঢ্য উত্থানের সুযোগও তৈরি করতে পারে।
বেসরকারি কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, জামায়াতের সম্ভাব্য ভোটআগের তুলনায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দলটির বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, মাঠের পরিস্থিতি এ জরিপেও পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়নি। বাস্তব অবস্থা আরও অনুকূলে রয়েছে। বিশেষ করে ইসলামি ও সমমনা কয়েকটি দলের সঙ্গে আসন ভিত্তিক সমঝোতার যে প্রক্রিয়া চলছে, তা সফল হলে জামায়াত এককভাবে বা জোটগতভাবে আরও অনেক আসনে সুবিধাজনক অবস্থানে যেতে পারে।
ইতোমধ্যে দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের উল্লেখযোগ্য সাফল্যকে জামায়াত নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে দেখছে। তারা বলছে—এটি তরুণ সমাজের রাজনৈতিক অভিমুখ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। প্রচলিত দুই প্রধান দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—তরুণদের আস্থার জায়গা হারিয়েছে। ফলে একটি নীতিভিত্তিক, শুদ্ধ ও সুশাসনের রাজনীতি খুঁজতে গিয়ে তরুণরা শিবিরকে আবারো বেছে নিচ্ছে। জামায়াত নেতৃত্বের বিশ্বাস, জাতীয় নির্বাচনেও এই স্রোত প্রতিফলিত হবে।
মাঠপর্যায়ে প্রচার চালানো প্রার্থীরা জানিয়েছেন, এখনকার প্রচারণায় মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি উন্মুক্তভাবে কথা বলছেন। আগে যারা জামায়াতকে সমর্থন করেননি বা সমর্থন করলেও প্রকাশ্যে বলতেন না, তারা এবার সহজেই দলটির প্রতি সমর্থন জানানোর প্রবণতা দেখাচ্ছেন। অনেকে বলছেন, দেশের সব প্রধান দলকেই দেখা হয়েছে—এবার একটি ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত ও আদর্শিক দলকে সুযোগ দেওয়া উচিত। বহু নারী ভোটারও প্রচারণায় এসে জানিয়েছেন, তারা স্থায়ী শান্তি, সুশাসন, নিরাপত্তা এবং মূল্যবোধনির্ভর নেতৃত্ব চান—যা তাদের মতে জামায়াতের প্রতীকের মধ্যেই বেশি প্রতিফলিত হয়।
নারী ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে জামায়াতের মহিলা বিভাগ ধারাবাহিক কর্মসূচি পরিচালনা করছে। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় উঠান বৈঠক, বিশেষ দোয়া, মহিলা সভা, দরিদ্র নারীদের চিকিৎসাসেবা, বিনামূল্যের মেডিকেল ক্যাম্প এবং সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি—এসবের মাধ্যমে তারা সাধারণ নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছেন। মহিলা বিভাগের নেতৃত্ব বলছে, নারী সমাজ এবার অভূতপূর্ব আগ্রহ দেখাচ্ছে। অনেকেই সোজাসুজি জানিয়েছেন, এবার তারা দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিতে চান।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, দেশের মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে নৌকা, ধানের শীষ এবং লাঙলের শাসন দেখেছে। তারা দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং সাংগঠনিক নৈরাজ্যের অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি চায়। জনগণ এখন একটি কল্যাণরাষ্ট্র চায়—যেখানে শাসকগোষ্ঠী জনগণের প্রতি জবাবদিহি থাকবে। তাঁর মতে, শুদ্ধ রাজনীতির বিকল্প হিসেবে জনগণ এবার জামায়াতকে এগিয়ে রাখছে, এবং সুষ্ঠু ভোট হলে দাঁড়িপাল্লার পক্ষে নীরব বিপ্লব নিশ্চিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও মনে করছেন, জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন প্রাতিষ্ঠানিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেলেও ভোটের মাঠে তাদের প্রভাব একেবারে হারিয়ে যায়নি। বরং পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারা দ্রুতই ভোটারদের কাছে নিজেদের নতুনভাবে তুলে ধরতে পারছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে আদর্শিক ও মূল্যবোধভিত্তিক রাজনীতির চাহিদা আবারো বাড়ছে—যা জামায়াতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।
এমন সব সূচক সামনে রেখে জামায়াতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অনেক নেতাই এখন আশাবাদী। তারা বলছেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লার জন্য বহু আসনে ভোটের ধারা পাল্টে যাবে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা হবে।



