নতুন বাংলাদেশ গড়তে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া প্রস্তুত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে সনদের কোনো শব্দ, বাক্য ও নীতিমালা সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সনদকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের প্রস্তাব রয়েছে। দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি আসায় সনদের বিশেষ মর্যাদার পাশাপাশি আইনি ভিত্তিও দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন, প্রধানমন্ত্রীর দলীয় প্রধান না হওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও কিছু বিষয় পরিবর্তনে গণভোটের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে, তবে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে দ্বিকক্ষের বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ও থাকবে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ কমিশনের কার্যক্রম ও জুলাই সনদের অগ্রগতি প্রধান উপদেষ্টা ও কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অবহিত করেন। আজ শুক্রবারের মধ্যে সমন্বিত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে এবং আগামী সপ্তাহে মতামত চেয়ে স্বাক্ষরের জন্য সনদ প্রস্তুত করা হবে।
সনদের তিনটি ভাগ প্রথম ভাগে পটভূমি, সংস্কার কমিশন গঠন ও কার্যক্রম; দ্বিতীয় ভাগে দলগুলোর ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো; শেষ ভাগে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ৯ দফা অঙ্গীকারনামা। গত ২৯ জুলাই সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০টি দল ও জোটকে খসড়ার নমুনা দেওয়া হয়, যার মধ্যে ২৮টি দল মতামত দিয়েছে এবং ১৮টি দল নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি দেওয়ার পক্ষে। প্রথম ভাগে উল্লেখ রয়েছে রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠন, মৌলিক সংস্কার, স্বাধীন বিচার বিভাগ, জবাবদিহিমূলক সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার ঐতিহাসিক সুযোগ ব্যবহারের কথা। দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব, সংবিধানের মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, স্থানীয় সরকার, আইনসভা, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, জনপ্রশাসন, স্বাধীন পুলিশ কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রস্তাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি প্রচলিত ভাষার স্বীকৃতি, নাগরিক পরিচয়ে ‘বাংলাদেশি’ শব্দ, সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র ও ধর্মীয় স্বাধীনতা উল্লেখ আছে যাতে কয়েকটি দলের আপত্তি রয়েছে। দ্বিকক্ষের আইনসভার উচ্চকক্ষের ১০০ সদস্য পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবে, প্রার্থী তালিকায় অন্তত ১০% নারী রাখার বাধ্যবাধকতা থাকছে, তবে এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ আছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল ও আস্থাভোট ছাড়া সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিচার বিভাগে সাবেক বিচারপতিদের জন্য আচরণবিধি, আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ, আইনজীবী সংগঠনকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাবেও ঐকমত্য রয়েছে, যদিও বিএনপিসহ কিছু দলের আপত্তি আছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনের হাতে দেওয়ার প্রস্তাবও আছে। শেষ ভাগের ৯ দফা অঙ্গীকারনামায় সনদের ব্যাখ্যা, প্রয়োগ ও বৈধতার এখতিয়ার আপিল বিভাগের হাতে থাকবে, সনদ সম্পূর্ণ আইনগতভাবে কার্যকর হিসেবে গণ্য হবে এবং এর বৈধতা বা প্রয়োজনীয়তা আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে গঠিত ছয়টি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে এই সনদ প্রণয়ন হচ্ছে, যা নিয়ে কমিশনের আশা দলগুলো স্বাক্ষর করবে এবং বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে।