বৃহস্পতিবার, আগস্ট ২১, ২০২৫
spot_img
Homeঅর্থনীতিসংস্কারে বিপদমুক্ত ব্যাংক খাত, ধুঁকছে দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠান

সংস্কারে বিপদমুক্ত ব্যাংক খাত, ধুঁকছে দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠান

গত এক বছরে বহু আর্থিক সূচকের পরিবর্তন হয়েছে। স্থিতিশীলতা ফিরতে শুরু করেছে অর্থনীতিতে। তবে এখনো সংকট কাটেনি পুরোপুরি। কারণ বেসরকারি খাত বা করপোরেট গ্রাহকদের রক্তক্ষরণ এখনো বন্ধ হয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হলেও ব্যাংক থেকে টাকা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ গ্রাহকের ভোগান্তি কাটেনি। নানা সংস্কার ও তারল্য সহায়তার পরও অনেক ব্যাংক এখনো গ্রাহকের জমা অর্থ সম্পূর্ণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

রপ্তানি আয় ও প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টস (বিওপি) পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে কোনো ব্যাংক থেকে ডলার না কিনেই।

সর্বশেষ তথ্য মতে, দেশের গ্রস রিজার্ভ আবারও ২২ বিলিয়ন থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

দুর্বল ব্যাংকগুলোর ১৪টি পর্ষদ বিলুপ্ত করা হয়, প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা নতুন করে ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়। ছোট অঙ্কের আমানতকারীরা কিছু অর্থ তুলতে পারলেও বড় অঙ্কের সঞ্চয় ফেরত পাওয়া অনেকের জন্য এখনো দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে।

কিছু দুর্বল ব্যাংক মাসে নির্ধারিত পাঁচ হাজার টাকাও দিতে পারছে না, আর গ্রাহকদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছেন শাখা ব্যবস্থাপকরা।


এস আলম গ্রুপের প্রভাবমুক্ত হয়েছে ব্যাংক খাত :

ব্যাংক খাত অবশেষে এস আলম গ্রুপের দীর্ঘদিনের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে গ্রুপটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তাঁর পরিবার দেশের ব্যাংক কম্পানি আইন ভেঙে সাতটি ব্যাংক ও দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের শেয়ার দখলে নিয়েছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থার শিথিলতার সুযোগে এস আলম গ্রুপ নজিরবিহীনভাবে ব্যাংক খাতে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বলেন, এস আলমের দখলমুক্তি এ দেশের ব্যাংক খাতের জন্য নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ।

কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এরই মধ্যে পাচার বন্ধ হয়েছে।


আইএমএফের ঋণের জন্য পরিবর্তন :

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের জন্য বহু পরিবর্তন হয়েছে আর্থিক খাতে। পাশাপাশি ব্যাংকঋণের নীতি সুদহার ও খেলাপি ঋণের নীতিমালাও পরিবর্তন করা হয়েছে আইএমএফের ঋণের জন্য। দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার এক লাফে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছে।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের গলা টিপে হত্যা করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে তিন মাস কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলে খেলাপি করার শর্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশে ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ নেই। ব্যবসায়ীরা আয় না করলে ব্যাংকের কিস্তি দেবেন কিভাবে? মন্দা অর্থনীতির বাজারে ব্যাংকঋণ পরিশোধ করা খুবই কঠিন হয়ে গেছে। এ কারণেই মূলত দেশের ঋণখেলাপি বেড়েছে। ’

ব্যাংক সংস্কারের উদ্যোগ :

সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই শুরু হয়েছে ব্যাংক খাতের সংস্কার। এর মধ্যে ১৪ ব্যাংকের পর্ষদ বদল, দেড় হাজারের বেশি অ্যাকাউন্ট জব্দ, এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ স্থগিত, তিনটি টাস্কফোর্স গঠন, ৫০ কোটি টাকার ওপরে অনিচ্ছাকৃত খেলাপিদের নীতি সহায়তা কমিটি গঠন ও সহায়তা প্রদান অন্যতম। তা ছাড়া দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার জন্য অধ্যাদেশের মাধ্যমে ব্যাংক রেজল্যুশন অ্যাক্ট জারি করেছে সরকার। এরই মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক মার্জ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর পরের ধাপে আরো ১০টি ব্যাংক নিয়ে কাজ করার কথা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের।

রেমিট্যান্স-প্রবাহে নতুন রেকর্ড :

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রবাসীদের মধ্যে রেমিট্যান্স পাঠানোর আগ্রহ বেড়ে যায়। জুলাইয়ে ২৪৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাস আয় এসেছে তিন হাজার ৩২ কোটি ডলার, দেশের ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ। আগে ক্রমাগত কমতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ডলার সংকট কাটতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা আগের চেয়ে সহজে এলসি খুলতে পারছেন।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা পরিচালক হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ প্রবাস আয়। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে দেশের রেমিট্যান্স বাড়ছে। এটা দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি লাভজনক। ’

ব্যাংকে বাড়ছে আমানত, ফিরছে আস্থা :

শেখ হাসিনার আমলে অনিয়মে নষ্ট হওয়া ব্যাংকব্যবস্থায় ফের আস্থা ফিরে আসছে। মে মাস পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা, এক বছরে আমানতের প্রবৃদ্ধি ৭.৭৩ শতাংশ।

পাচারের অর্থ ফেরানোর উদ্যোগ :

পাচারের অর্থ ফেরাতে প্রায় ২০০টি দেশে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সূত্র আরো জানায়, আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা জোট এগমন্টের সঙ্গে যুক্ত ১৭৭টি দেশ ছাড়াও একাধিক দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে বিএফআইইউয়ের। এর মধ্যে জবাব মিলেছে ২৭টির। দেশের পাচারকারীদের জন্য গঠন করা হয়েছে ১১টি জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম। তাদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশিদের প্রায় ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে যুক্তরাজ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ জড়িত সাইফুজ্জামান জাভেদ ও সালমান এফ রহমান পরিবারে, যাদের ফ্রিজ আদেশ ও অনুসন্ধান চলমান আছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে পাচারকারীদের তথ্য চাওয়া, ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ ও রিপোর্টিং করছে টাস্কফোর্স। এখানে সরাসরি সহযোগিতা করছেন যুক্তরাজ্যের এক্সপার্টরা। আমাদের দেশের লোকদের ট্রেনিং দিচ্ছে তারা। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাদের কাজ শেষ হলে দেশ ও বিদেশের আদালতে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলার দিকে যাবে বাংলাদেশ। ’

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা :

ব্যাংকবহির্ভূত কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন মৃতপ্রায়। তারা অনেক দিন ধরে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। পাচ্ছে না নতুন আমানতও। এমন পরিস্থিতিতে এই খাতকে বাঁচাতে প্রথম ধাপে ২০টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানতকারীর জমানো টাকা ফেরত দিতে না পারা, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি—এ তিন সূচকের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে।

বীমা খাতের শোচনীয় অবস্থা :

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বীমা খাতের উন্নয়নও ঘটে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে বিগত ১৫ বছরে বীমা খাতের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে নন-লাইফ ৪৬ কম্পানির কাছে মোট দাবি দাঁড়ায় তিন হাজার ৪৪৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। কিন্তু পরিশোধ করা হয়েছে মাত্র ২৯৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা, যা মোট দাবির ৯ শতাংশ। অর্থাৎ বাকি ৯০ শতাংশ দাবিই অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে।

ঋণ প্রবৃদ্ধি ও আস্থার সংকট :

গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই ঋণ প্রবৃদ্ধি ধাপে ধাপে কমেছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তা ছিল ১০.১৩ শতাংশ, যা জুনে নেমেছে ৬.৪০ শতাংশে। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিতে পারেনি, ফলে বেসরকারি খাত ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পিছিয়ে আছে। তবে নির্বাচনের ঘোষণা কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments