সংবাদ প্রতিবেদন
সাবেক পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ রাজসাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে সংঘটিত হয়।
তিনি বলেন, “এত বড় গণহত্যা আমার দায়িত্বকালীন সময়ে সংঘটিত হয়। তার দোষ আমি স্বীকার করছি।” এছাড়া তিনি গণহত্যার শিকার প্রত্যেক পরিবার, আহত ব্যক্তি, দেশবাসী ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তিনি এ ঘটনায় ক্ষমা চাইতে গিয়ে আবেগপ্রবণ ও অশ্রুসজল হয়ে পড়েন।
পুলিশের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং নির্বাচনের প্রভাব
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন জবানবন্দিতে বর্ণনা করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক মেরূকরণ হয় এবং গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক বলয় তৈরি হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় তিনি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন। তিনি জানান, নির্বাচনের আগের রাতে তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী প্রধানমন্ত্রীকে ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশ ব্যালট ভর্তি করার পরামর্শ দেন। এরপরে ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসিল্যান্ড, ওসি এবং দলীয় নেতাকর্মীরা সরকারপক্ষের পক্ষে কাজ করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুলিশের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়। পুলিশের মধ্যে দুটি প্রভাবশালী গ্রুপ গঠিত হয়। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং অন্যটির নেতৃত্বে ছিলেন এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম। এই গ্রুপগুলো তাদের নিজস্ব বলয়ের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টিং নিশ্চিত করতে চেয়েছিল, ফলে চেইন অব কমান্ড ভেঙে যায়।
র্যাব ও অন্যান্য বাহিনীর কার্যক্রম
চৌধুরী আল-মামুন বলেন, তিনি ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত র্যাবের ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময় তিনি জানতে পারেন, র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটের অধীনে বন্দিশালা ছিল, যেখানে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী ও সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের আটক, নির্যাতন ও ক্রসফায়ার করা হতো। এসব কার্যক্রমে র্যাবের এডিজি (অপস) ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকরা সমন্বয় করতেন।
তিনি উল্লেখ করেন, আন্দোলন দমনের নির্দেশ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত এবং নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকের মাধ্যমে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে এডিজি (অপস) ও র্যাব ইন্টেলিজেন্সের পরিচালকগণের কাছে পৌঁছে দিত।
জুলাই আন্দোলন ও কোর কমিটি বৈঠক
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন চলাকালীন দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন করা হয়। ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ধানমন্ডির সরকারি বাসায় কোর কমিটির বৈঠক হতো। বৈঠকে অংশগ্রহণ করতেন:
- সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর
- অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) টিপু সুলতান
- অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তফা
- এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম
- ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ
- র্যাব ডিজি ব্যারিস্টার হারুন-অর রশিদ
- ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান
- ডিজি বিজিবি মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী
- ডিজি আনসার মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক
- এনটিএমসির প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান
- ডিজিএফআই প্রধান ও এনএসআই প্রধান
কোর কমিটির বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়। ডিজিএফআই প্রস্তাব দেয়, যদিও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন তা বিরোধিতা করেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি রাজি হন এবং দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদকে। পরে ডিজিএফআই ও ডিবি তাদের আটক করে। আটক ব্যক্তিদের পরিবারকে চাপ দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করানো হয়।
আন্দোলন দমন: হেলিকপ্টার, ড্রোন ও লেথাল অস্ত্র
জুলাই আন্দোলনের সময়ে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ওপর নজরদারি এবং আক্রমণ চালানো হয়। র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন-অর রশিদ এই ব্যবস্থার পরামর্শ দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফোনে জানান, প্রধানমন্ত্রী সরাসরি লেথাল উইপন ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ আন্দোলন দমনে অতিউৎসাহী ছিলেন। সরকারকে উৎসাহিত করতেন আওয়ামী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী ও ব্যবসায়ীরা। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী চীন সফর শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এমন মন্তব্য করেন যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা চাকরি পাবে না। এরপর আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ও যুবলীগকর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়, পুলিশ তখন নিষ্ক্রিয় ছিল।
ক্ষমা ও দোষ স্বীকার
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, তিনি পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তিনি বলেন, “আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন। এই সত্য ও পূর্ণাঙ্গ বর্ণনার মাধ্যমে আমি আমার অপরাধবোধ থেকে কিছুটা মুক্তি পাব।”
তিনি আরও জানান, হত্যার পর লাশগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার বীভৎসতা তাকে অত্যন্ত মর্মাহত করেছে। তিনি ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন এবং শেষপর্যায়ে এত বড় গণহত্যা সংঘটিত হওয়ায় নিজেকে দায়ী মনে করছেন।
চিফ প্রসিকিউটরের মন্তব্য
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হয়ে তার দোষ স্বীকার করেছেন এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।



