জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রশাসনে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিলেও, মোখলেস উর রহমান জনপ্রশাসন সচিব হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা। মাত্র এক বছরের মধ্যেই গড়ে ওঠে প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী—যা প্রশাসনে পরিচিতি পায় ‘মোখলেস সিন্ডিকেট’ নামে।
এই সিন্ডিকেট সচিবালয় থেকে মাঠ প্রশাসন পর্যন্ত নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও দায়িত্ব বণ্টনে প্রভাব বিস্তার করে। অভিযোগ রয়েছে, শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, কোটি টাকার আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতেও শত শত কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী, মোখলেস উর রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পর মাত্র এক বছরে সচিব ও সিনিয়র সচিব পদে ৭২টি পোস্টিং অর্ডার করেন, যার মধ্যে ২৫টিরও বেশি বিতর্কিত। যুগ্ম সচিব পদে ৪৫০টির অর্ধেক, উপসচিব পদে ৭১০টির ৫০ শতাংশ, এবং সহকারী সচিব পর্যায়ে বড় অংশ আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের হাতে গেছে।
বঞ্চিত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে, অথচ প্রকাশ্যে রাজনৈতিক পরিচয় থাকা ব্যক্তিরা পদোন্নতি পেয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল জেলা প্রশাসক নিয়োগ। একজন ডিসি পদে বসতে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি সংশ্লিষ্ট যুগ্ম সচিবের কক্ষ থেকে ঘুষের চেক উদ্ধার হয়। বিষয়টি তদন্তে কমিটি গঠিত হলেও ফলাফল প্রকাশ পায়নি।
‘মোখলেস সিন্ডিকেট’-এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন মোখলেস উর রহমান নিজে, তার ঘনিষ্ঠ যুগ্ম সচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও কে এম আলী আজম। এরা মিলে জনপ্রশাসনের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করতেন। বর্তমানে তিনজনই সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতরে কর্মরত।
নিরাপত্তা সংস্থা সূত্র জানিয়েছে, এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ চলছে। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে, এবং যারা টাকার বিনিময়ে বদলি বা পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত হচ্ছে।
প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের এই পুনর্বাসন প্রশাসনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর যে নিরপেক্ষ প্রশাসনের প্রত্যাশা ছিল, তা ভেস্তে যেতে বসেছে।
সাবেক সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার বলেছেন, “মোখলেস সিন্ডিকেটের সময় প্রশাসন বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়েছিল। সরকারের উচিত তদন্তের মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করা।”
সেন্টার ফর আইডিয়া ইনোভেশনের নির্বাহী প্রধান রফিক আহমেদ ডলার বলেন, “২০২৪ সালের আগস্ট থেকে হওয়া পদায়ন ও প্রমোশনগুলো পর্যালোচনা না করলে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হবে। এই সিন্ডিকেট প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নষ্ট করেছে।”



