বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন। এর মধ্যে ২৪ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ মানুষ বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন। এসব দংশনের কারণে প্রতিবছর মৃত্যু হয় ৭ হাজার ৫১১ জনের। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হলেও এখনো জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে সাপে কাটার চিকিৎসা যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে ২৪৪ জন সাপের দংশনের শিকার হন এবং এতে ৫ জনের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যু না হলেও আক্রান্তদের ১১ শতাংশ বিষক্রিয়াজনিত পক্ষাঘাতে ভোগেন। বছরে প্রায় আড়াই হাজার গবাদিপশুরও মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে।
পেশাভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাপের দংশনের সবচেয়ে বেশি শিকার গৃহবধূরা—তাঁরা আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এরপর কৃষিশ্রমিক ২৬ শতাংশ এবং শিক্ষার্থী ১৯ শতাংশ। চিকিৎসা গ্রহণে এখনও বড় অংশের মানুষ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার পরিবর্তে ওঝার কাছে যান। তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্তদের ৬১ শতাংশ ওঝার কাছে যান, আর মাত্র ৩৫ শতাংশ প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবাদাতার কাছে। ওঝার অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কাজ না করায় মৃত্যুহার ও জটিলতা উভয়ই বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনম বা সাপের বিষের প্রতিষেধক কার্যকর কেবল তিন ধরনের বিষধর সাপের ক্ষেত্রে—চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার), গোখরা এবং ক্রেইট। কিন্তু সামুদ্রিক সাপ, গ্রিন পিট ভাইপারসহ অন্যান্য স্থানীয় প্রজাতির সাপে কাটলে এই অ্যান্টিভেনম কার্যকর নয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা জটিল হয়ে পড়ে।
অ্যান্টিভেনমের প্রাপ্যতা নিয়েও দেশে তীব্র সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছর অ্যান্টিভেনমের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। দেশে এটি বাজারজাত করে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান, যারা ভারতের তামিলনাড়ু থেকে তরল অ্যান্টিভেনম আমদানি করে ভায়ালে ভরে সরবরাহ করে। সরকার থেকে অ্যান্টিভেনম সরবরাহের কোনো কেন্দ্রীয় কার্যক্রম বা পরিকল্পনা (অপারেশনাল প্ল্যান) না থাকায় এখন প্রতিটি হাসপাতালকে নিজ উদ্যোগে কিনতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দেশে বছরে ১০ থেকে ২০ লাখ ভায়াল অ্যান্টিভেনমের প্রয়োজন হলেও এর একটি বড় অংশ ঘাটতিতে রয়েছে।
বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ ফায়েজ বলেন, “চিকিৎসা খাতে সাপের দংশনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। হাসপাতালভিত্তিক তথ্যও অসম্পূর্ণ। ফলে কোথায় কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে, তার পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায় না। অ্যান্টিভেনমের সঠিক বিতরণও হয় না। স্থানীয়ভাবে প্রতিষেধক উৎপাদন না হলে সংকট কাটানো সম্ভব নয়।”
তবে আশার কথা, দেশে নিজস্ব অ্যান্টিভেনম তৈরির উদ্যোগ শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে দেশীয় সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা চলছে। সেখানে রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টিভেনম তৈরির পর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে এবং ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে আগামী তিন বছরের মধ্যে স্থানীয়ভাবে অ্যান্টিভেনম উৎপাদনের ভিত্তি তৈরি হবে। এরপর উৎপাদনে যেতে সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইডিসিএলের আরও কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাপে কাটার চিকিৎসাকে জনস্বাস্থ্য অগ্রাধিকারে আনা এখন সময়ের দাবি। অ্যান্টিভেনমের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা ছাড়া সাপের দংশনে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে সাপের দংশনে প্রতি বছর যে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি ঘটছে, তা শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও তা গভীর প্রভাব ফেলছে। তাই দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণই হতে পারে এই অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলার একমাত্র কার্যকর উপায়।



