বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সিদ্ধান্তে মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেছে প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকার সম্পদ। ইসলামী ধারার পাঁচটি দুর্বল ব্যাংকের শেয়ার ‘শূন্য’ ঘোষণা করায় এক নিমিষে নিঃস্ব হয়েছেন অসংখ্য সাধারণ বিনিয়োগকারী। দেশের অর্থনীতিতে এ সিদ্ধান্ত এখন গভীর আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণায় বলা হয়েছে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক—এই পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার এখন থেকে মূল্যহীন হিসেবে বিবেচিত হবে। ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার আগে শেয়ারহোল্ডারদের ইকুইটির মূল্য নেতিবাচক হওয়ায় শেয়ারগুলোকে শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ১০ টাকা ফেসভ্যালুতে পাঁচ ব্যাংকের মোট ৫৮১ কোটি ৯৫ লাখ ৭১ হাজার ৯৫৯টি শেয়ার ছিল। যার বাজারমূল্য ছিল ৫,৮১৯ কোটি টাকারও বেশি। এই বিপুল অঙ্কের অর্থ এখন কার্যত অস্তিত্বহীন। এর মধ্যে প্রায় ৩৭ শতাংশ ক্ষতির ভার পড়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর ওপর। তাঁদের হাতে থাকা ২১৯ কোটি ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬৪টি শেয়ারের মূল্য ছিল প্রায় ২,২০০ কোটি টাকা, যা মুহূর্তেই তাঁদের পোর্টফোলিও থেকে মুছে গেছে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ছিল ২২৪ কোটি ৪০ লাখ ৩৭ হাজার শেয়ার, যার বাজারমূল্য ছিল ২,২০৩ কোটি টাকা। উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে ছিল ১৪৩ কোটি ২ লাখ ৭৫ হাজার শেয়ার, যার দাম প্রায় ১,৩৯০ কোটি টাকা। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীর হাতে থাকা এক কোটি ১৪ লাখ ৬৯ হাজার শেয়ারের মূল্য ছিল প্রায় ২৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এই সমস্ত বিনিয়োগ এখন পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকগুলো বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব, আত্মীয়করণ এবং ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে নিজেদের পুঁজিকে ধ্বংস করেছে। কিন্তু সেই দায়ভার এখন সাধারণ বিনিয়োগকারীর ঘাড়ে এসে পড়েছে। অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, “যারা ব্যাংক লুট করেছে, তাদের দায়ভার এখন সাধারণ বিনিয়োগকারীর ওপর চাপানো হচ্ছে—এটি আর্থিক অন্যায়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।”
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে এই পাঁচ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করেছে। গভর্নর জানিয়েছেন, শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, কারণ ব্যাংকগুলোর ইকুইটি মূল্য নেতিবাচক ৩০০ থেকে ৪০০ শতাংশে নেমে গেছে। তাঁর ভাষায়, “এই অর্থ আদায় করার কথা, কিন্তু তা না করে শেয়ারগুলোর মূল্য জিরো ধরা হয়েছে।”
অন্যদিকে আইনজীবী ও হিসাববিদরা বলছেন, কোম্পানি অবসায়ন বা মার্জের পর আইন অনুযায়ী দায় শোধের পর যদি কিছু সম্পদ অবশিষ্ট থাকে, তখন শেয়ারহোল্ডাররা তা পান। কিন্তু এই ব্যাংকগুলোতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই বলেই তাঁদের কিছুই দেওয়ার সুযোগ নেই। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার চাইলে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়তার উদ্যোগ নিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (AQR) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর লুটের পরিমাণই প্রায় ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর মোট আমানত ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা হলেও, মোট ঋণ ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা—অর্থাৎ গড় খেলাপি ঋণের হার ৭৭ শতাংশ।
ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই ঘটনাটি শুধু কয়েকটি ব্যাংক বা বিনিয়োগকারীর ক্ষতি নয়; বরং এটি গোটা শেয়ারবাজার ও আর্থিক ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। বাজারে আস্থার সংকট তৈরি হবে, নতুন বিনিয়োগ থেমে যাবে, আর ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
একজন ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী মো. মহসিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যারা ব্যাংক একীভূত করছে, তারা যেন আমাদের শেয়ার ফিরিয়ে দেয়। লুটের দায় সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাঁধে চাপানো অন্যায়।”
বাংলাদেশের আর্থিক ইতিহাসে এই ঘটনাটি এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে—যেখানে এক ঘোষণাতেই নিঃশেষ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, আর অর্থনীতির ওপর পড়েছে আস্থার গভীর ছায়া।



