বাংলাদেশের ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান নিয়ে নতুন করে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশি–বিদেশি ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক দুই দিনে চারবার ভূমিকম্পের পর বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—বাংলাদেশ এখন এমন এক উচ্চঝুঁকির অঞ্চলে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের ভূমিকম্প। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বহুদিন আগেই ইঙ্গিত করা হয়েছিল, গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নিচে লুকিয়ে থাকা এক বিশাল মেগাথ্রাস্ট ফল্ট বাংলাদেশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাতে পারে। সাম্প্রতিক কম্পনগুলো সেই ভয়াবহ আশঙ্কাকেই যেন সামনে এনে দিয়েছে।
গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নিচে ‘গোপন মেগাথ্রাস্ট ফল্ট’
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়—বাংলাদেশের উত্তর–মধ্য অঞ্চলে বিস্তৃত পুরু পললস্তরের নিচে রয়েছে একটি ‘গোপন ফল্ট’।
এই ফল্টটি দুই বৃহৎ প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত এবং ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায় একে বলা হয় মেগাথ্রাস্ট ফল্ট।
গবেষণাটি বলেছিল—
- এ এলাকায় শত শত বছর ধরে প্রচুর শক্তি সঞ্চিত হয়েছে
- যেকোনো সময় ৮.৫–৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে
- এটি হলে বাংলাদেশসহ পুরো উপমহাদেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো এই পূর্বাভাসকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
“আগামী এক সপ্তাহে আরও ২০ দফা ভূমিকম্প হতে পারে”—বিশেষজ্ঞ
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন,
“দুই দিনে চারবার ভূমিকম্প হয়েছে। এটি সাধারণ ঘটনা নয়। এ সপ্তাহে আরও ২০টি কম্পন অনুভূত হতে পারে। মাত্রা ধীরে বাড়লে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রচার হলেও প্রকৃত কেন্দ্র ছিল নরসিংদী অঞ্চল।
তিন টেকটোনিক প্লেটের চাপে বাংলাদেশ
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের ভূভাগ পৃথিবীর তিনটি বিশাল প্লেটের সংযোগস্থলে হওয়ায় ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।
এই তিনটি প্লেট হলো—
- ভারতীয় প্লেট
- ইউরেশীয় প্লেট
- বার্মা প্লেট
বাংলাদেশের নিচে এসব প্লেট আটকে ছিল বহু বছর। এখন সেগুলো ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে—যা বড় কম্পনের ইঙ্গিত।
ঢাবির ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন—
“বাংলাদেশে অসংখ্য ফল্ট থাকলেও সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো সিলেট–টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত সাবডাকশন জোন। প্রায় ৮০০–১০০০ বছর ধরে এখানে জমে থাকা শক্তি বের হয়নি।”
নরসিংদীর ঘোড়াশালে ফাটল—ডিইউ গবেষণা দল নমুনা নিয়েছে
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঘোড়াশাল এলাকায় গত দুই দিনে একাধিক স্থানে মাটি ফেটে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের একটি সাত সদস্যের গবেষণা দল শুক্রবার নমুনা সংগ্রহ করেছে ঘোড়াশাল ডেইরি ফার্ম, পলাশ রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজসহ বিভিন্ন স্থান থেকে।
তারা বলেছেন—
- নমুনা পরীক্ষা জানাবে ভূমিকম্পের গভীরতা
- কোন ধরনের শক্তি সঞ্চালন হয়েছে তা বোঝা যাবে
ইতিহাসও সতর্ক করছে
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন—
- ১৭৬২ সালে টেকনাফ–মিয়ানমার ফল্টে ৮.৫ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল
- সেন্টমার্টিন দ্বীপ ৩ মিটার উঁচু হয়ে যায়
- বঙ্গোপসাগরে সুনামিতে প্রায় ৫০০ মানুষের মৃত্যু হয়
তারা বলছেন, ওই অঞ্চলে আবার শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে—যা নতুন বিপদের ইঙ্গিত দেয়।
হিমালয়ের প্লেট সরছে—নতুন করে উদ্বেগ
টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, হিমালয়ের নিচে থাকা বিশাল টেকটোনিক প্লেট ধীরে ধীরে পূর্বদিকে সরে যাচ্ছে।
এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প—যা বিশেষজ্ঞদের মতে “উদ্বেগজনক সমাপতন”।
জনগণের করণীয়
বিশেষজ্ঞদের মতে—
- ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মানতে হবে
- দুর্বল ভবন আগে থেকেই শনাক্ত ও সংস্কার করতে হবে
- জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে
- সচেতনতা বাড়াতে হবে স্কুল–কলেজসহ জনসমাগমস্থলে
বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেছেন—
“এখনো সময় আছে। প্রস্তুত হলে বড় বিপর্যয় মোকাবিলা করা সম্ভব।”



