রবিবার, ডিসেম্বর ৭, ২০২৫
spot_img
Homeরাজনীতিবিএনপিআগামী নির্বাচন: অপপ্রচার প্রতিহত করাই বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ

আগামী নির্বাচন: অপপ্রচার প্রতিহত করাই বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সামনে রয়েছে প্রায় দুই মাস সময়, আর এই সময়ের মধ্যেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সম্ভাব্য প্রার্থীরা এখন পূর্ণমাত্রায় মাঠে নেমে ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যস্ত। তবে নির্বাচনী প্রস্তুতির এই পর্যায়ে বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিচ্ছে অপপ্রচার—বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিভ্রান্তিকর ও পরিকল্পিত প্রচারণা।

বিএনপির একাধিক প্রার্থী এবং কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনী প্রচার যত ঘনিয়ে আসছে, ততই তাদের বিরুদ্ধে সামাজিকমাধ্যমে মিথ্যা ভিডিও, বিকৃত অডিও এবং মনগড়া বক্তব্য ছড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মতে, কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয়, বরং ‘তৃতীয় পক্ষ’ও এসব ডিজিটাল অপপ্রচারে ইন্ধন দিচ্ছে, যার লক্ষ্য বিএনপির অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক দুর্বল করা, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোকে বিভক্ত করা এবং ভোটের মাঠে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করা।

বিএনপির প্রার্থীরা অভিযোগ করছেন—তাদের ছবি ও পুরোনো ভিডিও কাটছাঁট করে নতুন করে ভয়েস যুক্ত করা হচ্ছে; একজনের বক্তব্য অন্যজনের নামে চালানো হচ্ছে; জনপ্রিয় পেজ, ভুয়া অ্যাকাউন্ট, এমনকি সমন্বিত মন্তব্য বাহিনী ব্যবহার করে প্রচারণাকে নষ্ট করার চেষ্টা চলছে। প্রার্থীদের প্রতি জনমনে সন্দেহ তৈরির জন্য কিছু গ্রুপ তালেবরভাবে পুরোনো বিভিন্ন বক্তব্যকে নতুন রূপে সাজিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এতে সাধারণ ভোটার বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং রাজনৈতিক সহমর্মিতার জায়গায় বিরোধ ও উদাসীনতা তৈরি হচ্ছে।

এআই—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার—অপব্যবহার এ অপপ্রচারের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন বিএনপির অনেক প্রার্থী। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এআই টুল ব্যবহার করে কারও কণ্ঠস্বর নকল করা, বক্তব্য বিকৃত করা, পরস্পরবিরোধী মন্তব্য বানিয়ে সামাজিকমাধ্যমে ছড়ানো এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি হচ্ছে। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে এই অপব্যবহার বহুগুণে বাড়তে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

বিএনপির কয়েকজন প্রার্থী আরও জানান, বিভিন্ন এলাকায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে অন্য দলের প্রার্থীর পোস্টারের ওপর বিএনপির পোস্টার বা স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে—যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ মনে করে বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের প্রচারণায় বাধা দিচ্ছে। এতে বিভ্রান্তি বাড়ছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রার্থীদের মতে, এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য জোটবদ্ধ ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক ধারার মধ্যে সন্দেহ ও দ্বন্দ্ব জাগিয়ে তোলা।

ফেসবুক ও ইউটিউবে ভুয়া ফটোকার্ড এখন নির্বাচনী অপপ্রচারের প্রধান হাতিয়ার—এ তথ্যও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে পরিচালিত অসংখ্য পেজ ও আইডি থেকে যেসব ছবি প্রচার করা হচ্ছে, তার অধিকাংশই বিকৃত বা মনগড়া। এতে সাধারণ মানুষ কোনো খবরের সত্যতা যাচাই না করেই বিভ্রান্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সোশ্যাল মিডিয়ার এই অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারকে বিএনপি নেতারা একটি বড় জাতীয় সমস্যার মতো দেখছেন।

গত ২৮ নভেম্বর প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে এসব অপপ্রচার নিয়ে সরাসরি কথা বলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি সতর্ক করে বলেন, সামাজিকমাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিত প্রচারণা এখন “নৈরাজ্যের পর্যায়ে পৌঁছেছে।” তাঁর মতে, সামাজিকমাধ্যমে দায়বদ্ধতার অভাব রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং ব্যক্তিগত চরিত্রহননের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে দমন করা হচ্ছে।

এর আগে ২ নভেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়াল বক্তব্যে বলেন, বিএনপির বিজয় ঠেকাতে নতুন করে একটি সংগঠিত অপপ্রচারের নেটওয়ার্ক সক্রিয় হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে যারা বিশ্বাসী, তারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্রই বিএনপিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।”

দলের শীর্ষ নেতারা আরও মনে করেন, কেবল প্রতিপক্ষের অপপ্রচার নয়, কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের কিছু নেতার অযাচিত মন্তব্যও বিষয়টিকে জটিল করছে। এমন বিবৃতি দলীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করছে এবং সেগুলো প্রতিপক্ষের হাতে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এজন্য বিতর্কিত মন্তব্য বা আচরণের কারণে কয়েকজন নেতাকে ইতোমধ্যে সতর্ক করা হয়েছে, এবং প্রার্থীদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

যশোর-৬ আসনের বিএনপির প্রার্থী ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, তাঁর ক্ষেত্রে এখনো বড় আকারে অপপ্রচার দেখা না গেলেও, তৃতীয় পক্ষ পরিকল্পিতভাবে বিভেদ তৈরির চেষ্টা করছে। তিনি জানান, তাঁর এলাকার জামায়াত প্রার্থীর পোস্টারের ওপর তাঁর স্টিকার লাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে—যা তাঁর মতে, তাঁকে ও জামায়াত প্রার্থীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর কৌশল।

সামাজিকমাধ্যমে মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে কীভাবে সজাগ থাকতে হবে—এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান শ্রাবণ। তিনি বলেন, বৈধ ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে সময়মতো সত্য তুলে ধরা ও মিথ্যা প্রচারণার জবাব দেওয়া এখন দলের নির্বাচনী কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বিএনপির কেন্দ্রীয় মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেলও অপপ্রচারের ব্যাপারে একই উদ্বেগ তুলে ধরেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, পোস্টারে বিকৃত ছবি ব্যবহার, ভুয়া অডিও তৈরি, কথোপকথনের অংশ কেটে নতুন গল্প বানানো, বট অ্যাকাউন্ট দিয়ে সংগঠিত আক্রমণ, পুরোনো ভিডিওকে নতুন রূপে ছড়ানো—সব মিলিয়ে একটি সুসংগঠিত অপপ্রচার নেটওয়ার্ক এখন সক্রিয়। তিনি মনে করেন, নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, এআই-ভিত্তিক প্রতারণা এবং ডিজিটাল বিভ্রান্তি ততই ব্যাপক হবে।

এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি বিটিআরসিকে (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান। ব্যবহারকারীর ফেসবুক আইডিকে জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার বাধ্যবাধকতা থাকলে অপপ্রচারকারীদের মধ্যে একটি শঙ্কা তৈরি হবে বলে তিনি মনে করেন।

বিএনপির মতে, এসব অপপ্রচারের পেছনে যে উদ্দেশ্য কাজ করছে তা স্পষ্ট—ফ্যাসিজমবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা, ভোটের পরিবেশকে নষ্ট করা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সন্দেহের মধ্যে ঠেলে দেওয়া। দলের ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, নির্বাচন যাতে ব্যাহত হয়, সে জন্য কিছু মহল পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত পরস্পরের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় না জড়িয়ে একযোগে অপশক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া।

দলের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশনা খুব স্পষ্ট—অপপ্রচারের জবাব দিতে হবে দায়িত্বশীলভাবে, কিন্তু আবেগ নিয়ে নয়; সত্য তথ্য তুলে ধরতে হবে, কিন্তু বিভেদ তৈরি করে এমন কোনো উত্তেজনায় জড়ানো যাবে না। রিপন বলেন, “এখন আমাদের সবচেয়ে বড় লড়াই নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়—বরং নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য রাখা।”

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments