মানুষের জীবনের যেন কোনো মূল্য নেই। মানুষ সব সময় শঙ্কার মধ্যে দিন পার করছে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে জীবনযাপন করছে। প্রিয় বাংলাদেশ যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে! গণপিটুনি, রোড অ্যাক্সিডেন্ট ও ম্যানহোলে পড়ে যাওয়ায় সংঘটিত মৃত্যুর ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন ডোবায়-নালায় ও লাগেজের ভেতর খণ্ড-বিখণ্ড লাশ পাওয়া যাচ্ছে। আবার কাউকে ইট কিংবা পাথর দিয়ে থেঁতলে মারা হচ্ছে। তুচ্ছ কারণে কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে মানুষকে।
মানবজীবনের মূল্য
ইসলামের মৌলিক লক্ষ্যগুলোর প্রধান একটি হলো মানুষের জান-মাল-সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রাসুল (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, ‘জেনে রেখো, নিশ্চয়ই তোমাদের মাল-সম্পদ, তোমাদের সম্মান ও তোমাদের রক্ত (জীবন) তোমাদের পরস্পরের ওপরে হারাম, যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম।’ (বুখারি ও মুসলিম)
একজন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা পুরো মানবজাতিকে হত্যা করার মতো অপরাধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এ কারণেই আমি বনি ইসরাইলের জন্য বিধান দিয়েছিলাম, যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা জমিনে সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করবে, সে যেন পুরো মানবতাকেই হত্যা করল। আর যে মানুষের প্রাণ বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল।’ (সুরা মায়িদা : ৩২)
আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা
আমাদের জীবনের সব সমস্যার মূল কারণ আল্লাহর হুকুম অমান্য করা। তাই সালাফরা সবসময় বলতেন একটি মূলনীতি—‘কোনো বিপদ আসে না গুনাহ ছাড়া আর কোনো বিপদ দূর হয় না তাওবা ছাড়া।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে সমুদ্রে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম : ৪১)
বিশ্বের সব আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই আধুনিক রাষ্ট্রে নির্বাচিত সরকার হোক বা অনির্বাচিত, ভিআইপি লোকেরা স্পেশাল সিকিউরিটি নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে যাতায়াত করে। সবখানে ক্ষমতাবানদের জন্য নিরাপত্তার বেষ্টনী। নেই শুধু সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা। অথচ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা না দিতে পারলে আল্লাহর আদালতে জবাবদিহি করতে হবে দায়িত্বশীল সবাইকে। এজন্য ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) বলতেন, ফোরাতের তীরে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তাহলে সেজন্যও আমাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে।
নিষ্ঠুর অপরাধে কঠোর শাস্তি
দুঃখের বিষয় দেশে কেমন যেন বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এই যে জনসম্মুখে হত্যাগুলো হলো এবং হচ্ছে, এর কোনোটার বিচারই এখনো দৃশ্যমান পর্যায়ে আনতে ব্যর্থ এই অন্তর্বর্তী সরকার। বিচারে চরম অবহেলা ও ধীরগতি। পক্ষান্তরে ইসলামে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ‘কিসাস’ নামে একটা বিধান দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন নিহিত রয়েছে, যাতে হে জ্ঞানী সমাজ! (খুন-হত্যা থেকে) তোমরা নিবৃত্ত থাকো।’ (সুরা বাকারা : ২৭৯)
কিসাসের শাব্দিক অর্থ হলো, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় হত্যার বদলে হত্যা করা। কিসাসের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা আধুনিক রাষ্ট্রগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। যেমন কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, তাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য তাকেও হত্যা করা হবে—হোক সে রাষ্ট্রপ্রধান বা তার সন্তান বা নিকটজন। ইসলামে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। একদিকে ইহুদি অন্যদিকে মুসলিম, বিচারকও মুসলিম। অথচ ন্যায়ের মানদণ্ডে রায় যাচ্ছে ইহুদির পক্ষে। আইন সুষম প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিখ্যাত বাণীই রয়েছে হাদিসে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করে, তবে তার হাত কেটে দিতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না।’
শরিয়াহ আইনের সৌন্দর্য
ইসলামি শাসনের প্রধান দিকই হচ্ছে শাসন হবে বৈষম্যহীনভাবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কোথাও কোনো বৈষম্য থাকবে না। আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। শাসনের ক্ষেত্রে থাকবে না রাজা আর প্রজার কোনো পার্থক্য। ইসলামি আইন একাধারে চির-আধুনিক, বাস্তবিক ও মানবিক। এই ইসলামি আইনকে যদি কেউ সেকেলে বা এ যুগে অচল মনে করে, তাহলে সে ব্যক্তির ঈমান থাকবে না। সে মুরতাদ হয়ে যাবে। ইসলামি শাসনের কথা বললেই একদল ট্যাগ দেয়, পাকিস্তানে পাঠাতে চায়। প্রিয় ভাই, বিষয়টা রাজনৈতিক নয়, বিষয়টা ঈমানের।
কিসাসের আরেকটি দিক হলো, যদি কেউ কাউকে হত্যা করে, তাহলে তার ওপর কিসাস চলে আসবে, তার বাঁচার উপায় নেই। বাঁচার একটিমাত্র পথ—নিহত ব্যক্তির অলি-অভিভাবক কর্তৃক রক্তপণ নিয়ে বা রক্তপণ ছাড়াই তাকে মাফ করে দেওয়া। অপরদিকে গণতন্ত্রে আল্লাহর এই নীতিমালা উপেক্ষা করে মজলুম পরিবারের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির কাছে জীবন ভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে! এটা একদিকে মজলুম পরিবারের প্রতি অবিচার, অপরদিকে পরের ধনে পোদ্দারি। রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষা দেবেন কীভাবে? তিনি কি কারো প্রাণ বা জীবনের মালিক? একমাত্র আল্লাহই হলেন জীবনের স্রষ্টা ও জীবনদাতা। ‘তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। আর তিনি জমিনকে জীবিত করেন তার মৃত্যুর পর।’ (সুরা রুম : ১৯)
মানবরচিত আইন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে না, আল্লাহর আইন কেবল সেটা পারে। দেখুন, মিটফোর্ডের সামনে পাথর দিয়ে হত্যার পর ধার্মিক জনগণ শুধু নয়, সাধারণ জনতাও দাবি করছেন, প্রকাশ্যে খুনের বিচার করা হোক। অথচ সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগেই আল্লাহ তায়ালা বিধান দিয়েছেন, খুন-ধর্ষণের মতো বীভৎস অপরাধের শাস্তি হবে প্রকাশ্যে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর আইন কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের প্রতি দয়ামায়া তোমাদের যেন প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাত দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক।
একদল মু’মিন যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ (সুরা নুর : ২)
অতএব আমাদের বুঝতে হবে, মানবরচিত তন্ত্রমন্ত্র আর শাসনব্যবস্থার চাইতে ইসলামিক শাসন অর্থাৎ শরিয়াহর ব্যবস্থা প্রকৃত বৈষম্যহীন, জনবান্ধব, মানবিক ও কল্যাণকর। তাই আমরা মনে-প্রাণে ইসলামি শাসন চাইব এবং প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করব।
ইসলাম ও ইসলামি শাসন
প্রসঙ্গত, একটা কথা বলি, ইসলামি শাসন আপনারা চান কি চান না? নাকি শুধু জামায়াতে ইসলামী চায়? বস্তুত প্রত্যেকটা মুসলমান চায়। আপনি না চাইলে আপনি মুসলমান নন। তাহলে ইসলামি শাসনের কথা বললেই জামায়াত ট্যাগ দেওয়া হবে? চরমোনাই কি ইসলামি শাসন চায় না? নাকি ইন্ডিয়ার শাসন চায়? খেলাফতে মজলিস কি ইসলামি শাসন চায় না? নাকি ওয়াশিংটনের শাসন চায়? জমিয়তে ইসলাম কি ইসলামি শাসন চায় না, নাকি শয়তানের শাসন চায়? সবাই ইসলামি শাসনই চায়। অথচ ইসলামি শাসনের কথা বললেই জামায়াত ট্যাগ দেওয়া হয়। আর পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে চায়।
আমাদেরও ওরা ট্যাগ দিতে চায়। যা মনে চায় ট্যাগ দিক, জামায়াত বলুক, মৌলবাদী বলুক, তাতে আমাদের কিছুই আসে-যায় না। আমরা আমাদের কাজ করেই যাব ইনশাআল্লাহ। যেখানে ইসলাম থাকবে, সেখানে আমরা থাকব। যেখানে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা হবে, সেখানেই প্রতিবাদ করব, প্রতিরোধ করব ইনশাআল্লাহ। ইসলামের বিপক্ষে আমার ওস্তাদ, শায়েখ, পীর যে-ই যাবেন, তাদের কাউকে ছেড়ে দেব না। আলেমরা ছাড় দেয় না। তার প্রমাণ, মাও. সাদ সাহেব, তিনি কওমি আলেম, দেওবন্দি আলেম। অথচ যখন তিনি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে স্বয়ং দেওবন্দ।
আমাদের অভীষ্ট হলেন আল্লাহ। তাঁর পথ হলো সিরাতে মুস্তাকিম। একে অপরের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও ঘৃণা হবে শুধু আল্লাহর জন্য। এতে যে বাধা হয়ে আসবে, তাকে আমরা ছাড় দেব না। এতে স্বয়ং কেউ আমাদের নিকট আত্মীয় হলেও তাকে ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না। এমনটা করতে পারলে আমাদের ঈমান হবে পরিপূর্ণ। ঈমান পূর্ণ হলে রাসুল (সা.) যে শাসনব্যবস্থা এনেছিলেন, খোলাফায়ে রাশিদিন (রা.) যে শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেখানে ছিল চারদিকে শান্তি আর কল্যাণ। সবাই ছিল নিরাপদ। ইয়েমেনে সানআ থেকে হাজরামাউত পর্যন্ত রাতের আঁধারে একজন নারী একাকী হেঁটে গেলেও কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়নি। আর আমাদের? মেইন রোড থেকে বাসায় আসতে মোবাইল তো দেওয়াই লাগে, অনেক সময় জীবনও দিতে হয়! কারণ আমরা আছি দুষ্টের শাসনে। যদি ইসলামি শাসন থাকত, তাহলে হয় এগুলো তাওবা করে ভালো হয়ে যেত, না হয় কারো হাত, কারো পা এমনকি গলাও কাটা যেত।
দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে
বন্ধুরা ইসলামি শাসন চাওয়া, ইসলামি শাসনের জন্য চেষ্টা করা প্রত্যেকটা ঈমানদারের দায়িত্ব, কোরআন খুলে পড়ে দেখুন। আপনি যদি ইসলামি শাসন না চান, তাহলে আপনার ঈমান পূর্ণতা পাবে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সেই সুদিন দেখার তাওফিক দান করুন, যেদিন ইসলামি শাসন কায়েম হবে আর আমরা আল্লাহর আইন দিয়ে শাসিত হবো।
পরিশেষ, চারদিকে যেভাবে মৃত্যুর বিভীষিকা লক্ষ করছি, তাতে আমরা নিজেদের অনিরাপদ অনুভব করছি সর্বক্ষণ। আসুন আমরা তাওবা করি, অনুশোচনা করি, সংশোধিত হই। কারণ সব বিপদ আমাদের নিজেদের হাতের কামাই।
ব্যক্তির নিরাপত্তায় সুন্নতি আমল
রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করবে, এর ব্যত্যয় ঘটলে আমরা পরিবর্তন চাইব, সমালোচনা করব। আর নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিজে সচেতন হব। ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তার জন্য কোরআন-সুন্নাহে সুন্দর সুন্দর দোয়া, অজিফা ও আমল শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রথম কাজ হবে ফরজ নামাজ দিয়ে দিন শুরু করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ পড়ল, সে মহান আল্লাহর জিম্মায় রইল।’ (ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
এরপর সকাল-সন্ধ্যার জিকির করা। প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর নির্দিষ্ট দোয়া ও জিকির করা। ঘুমানোর সময় ও ঘুম থেকে উঠে নির্দিষ্ট দোয়া ও জিকিরগুলো আদায় করা। বাড়ি থেকে বের হওয়ার দোয়া, বিদায় জানানোর দোয়া, যানবাহনে আরোহণ ও গন্তব্যে প্রবেশের দোয়া পড়া। শায়খ আহমাদুল্লাহর সকাল-সন্ধ্যার দোয়ার বই, হিসনুল মুসলিম ও মুসলিম বাংলা অ্যাপসে এসব দোয়া-জিকির পাবেন। সেখান থেকে মুখস্থ করে আমল করতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন। সবার জান-মাল হেফাজত করুন।
৮ আগস্ট ২০২৫ টঙ্গীর আন-নুর জামে মসজিদে প্রদত্ত জুমার বয়ান থেকে অনুলিখন—
আব্দুল খালেক আশিক