রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ অমীমাংসিত রেখেই সরকার নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের গেজেট জারি করেছে। এর ফলে জোটবদ্ধভাবে এক দলের প্রতীকে অন্য দলের প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। নতুন বিধান অনুযায়ী, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব প্রার্থীকে নিজেদের দলীয় প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে।
নতুন অধ্যাদেশে প্রার্থী মনোনয়ন, যোগ্যতা, নির্বাচনী আচরণবিধি ও আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে। একজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিলের সাত দিন আগে থেকে এবং নির্বাচিত হওয়ার পর পাঁচ বছরের মধ্যে ঋণখেলাপি হলে তাঁর আসন শূন্য ঘোষিত হবে। পলাতক আসামিদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগও বন্ধ করা হয়েছে, আর অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থাও বাতিল করা হয়েছে।
আরপিও সংশোধনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে সশস্ত্র বাহিনী সদস্যরাও এখন পুলিশের মতো ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, এতে আলাদা নির্দেশনার প্রয়োজন হবে না।
এছাড়া ‘না ভোট’ আংশিকভাবে ফিরেছে—যদি কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকে, তবে ভোটাররা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন। জামানতের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং চালু করা হয়েছে, অনিয়মের কারণে পুরো আসনের ভোট বাতিল করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে।
নতুন আরপিওতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহারকে নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং প্রার্থীর হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে নির্বাচনের পরও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ইসিকে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা সদস্য থাকা প্রার্থীর অযোগ্যতা সংক্রান্ত প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শুধু নির্বাহী বা বিচারিক হাকিমই নয়, ইসির ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও ব্যবস্থা নিতে পারবেন। এ ছাড়া সমভোট হলে পুনঃভোট অনুষ্ঠিত হবে, এবং প্রার্থীদের দেশি-বিদেশি সম্পদের বিবরণী দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
নতুন বিধান অনুযায়ী, দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্যানেল বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব, দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও আর্থিক স্বচ্ছতার শর্ত, অঙ্গসংগঠন বিলুপ্তির সুপারিশ—এসব প্রস্তাব উপেক্ষিত হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার এ নিয়ে তীব্র হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন, কমিশনের সুপারিশের অধিকাংশই বিবেচনা করা হয়নি।
আরপিও সংশোধনের খসড়া অনুমোদন হয় গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। এতে বিএনপি আপত্তি জানায়, কারণ এক দলের প্রতীকে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনের সুযোগ বন্ধ করা তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রভাবিত করবে বলে মনে করে দলটি। যদিও জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই সংশোধনকে সমর্থন জানায়।
বিএনপি ও তাদের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকেও আপত্তি তোলে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এই পরিবর্তনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া উচিত ছিল। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, জোটের দলগুলো আলাদা প্রতীকে নির্বাচনে গেলে প্রচারণা কঠিন হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে এনসিপি এই সংশোধনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, যারা প্রকৃত রাজনীতি করে না, তারা বড় দলের ছায়ায় থেকে প্রতীকের সুবিধা নেয়; নতুন বিধান এ ধরনের সমঝোতা কমাবে এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতা আনবে।
ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা আইন, নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ বিধান, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ভোটকেন্দ্র নীতিমালা, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষণ ও সাংবাদিক নীতিমালাসহ নির্বাচনী কাঠামোর প্রায় সব আইনি সংস্কার সম্পন্ন করেছে সরকার ও ইসি। নতুন আরপিও অনুযায়ী শিগগিরই দল ও প্রার্থীর আচরণবিধি জারি করবে নির্বাচন কমিশন।
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই গেজেট প্রকাশে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্কের সূচনা হয়েছে, যা আগামী নির্বাচনের চরিত্র ও অংশগ্রহণ নিয়ে নতুন প্রশ্নও তুলছে।



